রাজনীতি

আন্দোলনে অর্জন শূন্য, হতাশ বিএনপি

গত ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে মহাসমাবেশের দিন পিটিয়ে পুলিশ হত্যা, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা এবং পুলিশ হাসপাতালে ভাঙচুর ঘটনার পর ২৯ অক্টোবর থেকে চার দফায় ৫ দিন হরতাল এবং ১২ দফায় ২৩ দিন অবরোধ কর্মসূচি পালন শেষে বিএনপির অর্জন মোটামুটি শূন্য। হঠাৎ ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলনেও দৃশ্যমান কোনো অর্জন নেই দলটির। এই মুহূর্তে গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে মাঠে ফেরার চেষ্টা করছে বিএনপি।

কিন্তু হরতাল-অবরোধের মধ্যে আড়াই শতাধিক যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, রেলে বড় ধরনের ছয়টি নাশকতার ঘটনায় ৫ জনের প্রাণহানী এবং এসব ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া সন্দেহভাজন অভিযুক্তদের জবানবন্দির ভিত্তিতে ধরপাকড় শুরু হওয়ায় বিএনপির মাঠে ফেরার পথও বন্ধ হওয়ার উপক্রম। ফলে দলটির নেতা-কর্মীদের মধ্যে কাজ করছে নিদারুণ হতাশা। ‘ভোট হয়েই যাবে’— এমন ভাবনা এখন বিএনপির সবার মধ্যে।

মাস দুয়েক আগেও বিএনপির নেতারা সরকারকে চাপে ফেলর ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন। নির্বাচন প্রতিহত করা যাবে— এমন একটি আশা দলটির নেতা-কর্মী, সমর্থকদের মধ্যে কাজ করছিল। সেই আশার ভিত্তিতেই অবরোধ-হরতালের মতো কঠোর কর্মসূচিতে যায় দলটি। কিন্তু, এখন বিএনপির কট্টর সমর্থকেরাও বলছে, ‘আর হবে না, নির্বাচন হয়েই যাবে। বিএনপির আন্দোলন ভুল পথে এগোচ্ছে।’

বিশ্লেষকরা বলছেন, যে লক্ষ্য নিয়ে বিএনপির আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেটির সুযোগ তারা এরই মধ্যে হারিয়ে ফেলেছে। সরকার এখন কোনো চাপে নেই। হরতাল-অবরোধ এখন ভোতা অস্ত্র হিসেবে মনে হচ্ছে। কঠোর কর্মসূচি দিয়ে তারা যে অস্বাভাবিক অবস্থা তৈরির চেষ্টা করেছিল, সেটা হয়নি। বরং টানা হরতাল-অবরোধ দিয়ে এর কার্যকারিতা নষ্ট করে ফেলেছে বিএনপি। দুই মাস ধরে সপ্তাহের চার দিন হরতাল-অবরোধ ডাকায় মানুষের ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে। সড়কে গাড়ির চাপ বেড়েছে দিনকে দিন। কিন্তু রাজপথে দেখা যায়নি বিএনপির নেতা-কর্মী, সমর্থকদের।

বিএনপির হরতাল-অবরোধের মধ্যেই ভোটের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। ৪৪টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে নির্বাচনে এসেছে ২৮টি। ২০১৪ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট যখন ভোট বর্জন করেছিল, তখন অংশগ্রহণকারী দলের সংখ্যা ছিল মাত্র ১২টি। ওই নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি। এবার তেমনটি হচ্ছে না। সব আসনেই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী রয়েছে। জমজমাট লড়াইয়ের পাশাপাশি শতভাগ সুষ্ঠু নির্বাচনে ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ সরকার এবং নির্বাচন কমিশন।

এমন পরিস্থিতিতে আন্দোলনের সফলতা নিয়ে বিএনপির নেতা-কর্মী, সমর্থকেরা যারপনাই হতাশ। চলমান গণসংযোগ, লিফলেট বিতরণ, আলোচনা সভা, মানববন্ধন ও ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে দলটির নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে হতাশার সুর স্পষ্ট। কয়দিন আগ পর্যন্ত নির্বাচন প্রতিহত করার দৃঢ় প্রত্যায় ব্যক্ত করলেও এখন আর তা বলছেন না। এখন শুধু হিসাব কষছেন নির্বাচনের পর কয়দিন টিকবে সরকার।

আন্দোলন শুরুর দেড় মাসের মাথায় ১৪ ডিসেম্বর শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস এবং ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস সামনে রেখে একটু দম নেয় বিএনপি। ওই দুইটি জাতীয় দিবসের আগে নরম কর্মসূচি পালন শেষে ফের কঠোর কর্মসূচিতে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল দলটির। ‘সরকারকে নির্বাচন করতে দেওয়া হবে না’— এ পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামার পরিকল্পনা ছিল বিএনপির।

কিন্তু, তফসিল ঘোষণার পর বড় ধরনের জমায়েতের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের আপত্তি থাকায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ভোটের আগে যেন বড় ধরনের সভা-সমাবেশের অনুমতি দেওয়া না হয়। ফলে, বড় ধরনের গণজমায়েতের মাধ্যমে অস্বাভাবিক অবস্থা তৈরির সুযোগটাও হাতছাড়া হয়েছে বিএনপি এবং তাদের রাজনৈতিক মিত্রদের।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০২২ থেকে বিএনপির কর্মসূচি সঠিক পথেই এগোচ্ছিল। তারা যে আন্দোলন করছিল, তাতে তাদের নিষ্ক্রিয় কর্মী-সমর্থকরা সক্রিয় হচ্ছিল। কিন্তু অবরোধের মতো চূড়ান্ত কর্মসূচি দিয়ে খেই হারিয়েছে দলটি। ৫৯৬ সদস্য বিশিষ্ট জাতীয় নির্বাহী কমিটির ৯০ জনের মতো শীর্ষস্থানীয় নেতা কারাগারে। বাকিরা আত্মগোপনে বা নিষ্ক্রিয়। এই অবস্থায় কেবল রুহুল কবির রিজভী ভার্চুয়াল ব্রিফিংয়ে দলের বক্তব্য ও অবস্থান তুলে ধরছেন। পাশাপাশি সপ্তাহের যে চারদিন কর্মসূচি থাকে, সেই চারদিন ভোর বেলায় ঝটিকা মিছিলে দেখা যায় তাকে। তার সঙ্গে নেতা-কর্মীদের অংশগ্রহণ থাকে খুবই কম।

বিশ্লেষকরা বলছেন, লক্ষ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিএনপি ভুল করেছে। তাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা, সরকার পতন নয়। তাছাড়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচন করলে ক্ষমতায় যেতেই হবে, এ ধারণাটাও ছিল ভুল। বিরোধী দলে থাকা মানেও ক্ষমতাকাঠামোর মধ্যে থাকা। বিএনপির বোঝা উচিত ছিল- জনগণ অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়, স্বাধীনভাবে ভোট দিতে চায়। কিন্তু, সরকার পতনের আন্দোলনে রাস্তায় নেমে গুলি খেতে চায় না।

কেউ কেউ মনে করছেন, বিএনপির ভোট বর্জন সিদ্ধান্তটাও ভুল ছিল। দল ছেড়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হওয়ার আগে এ কথাটিই বলে গেছেন বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যানের ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর বীর উত্তম। দশম সংসদ নির্বাচন থেকেই বিএনপি ভুল করে আসছে, এ কথা প্রকাশ্যেই বলছেন দলে নিস্ক্রিয় হয়ে পড়া আরেক ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘আমরা তো ২০১৪ সালে ভোট বর্জন করে চেষ্টা করেছি, ২০১৮ সালে ভোটে অংশ নিয়েও চেষ্টা করেছি। কিন্তু সংকট নিরসন হয়নি। আমরা মনে করি, এই সরকার ক্ষমতায় থাকলে আমরা ভোটে যাই বা না যাই, কিছু আসবে যাবে না। তারা (আওয়ামী লীগ) তাদের পরিকল্পনা মতো সাজানো নির্বাচনই করবে।’

কেউ কেউ মনে করেন, বিএনপি বারবার সময় বেঁধে দিয়ে ভুল করেছে। এটা তাদের নেতৃত্বের অপরিপক্কতা। ওমুক তারিখের মধ্যে এটা করে ফেলব, ওটা করে ফেলব, কিন্ত যখন কিছুই করতে পারেনি, তখন তাদের কর্মীদের মনোবলে চিড় ধরিয়েছে। আবার ‘নির্বাচনে যাব না, সংলাপে যাব না’— এমন নেতিকবাচক অবস্থানও বিএনপিকে ভুগিয়েছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।

এদিকে নেতৃত্বের সংকট বিএনপিকে ভুগিয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, বিএনপির চেয়ারপারসন সাজাপ্রাপ্ত এবং বন্দি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সাজা পেয়ে বিদেশে অবস্থান করছেন। সময়ের প্রয়োজনে এবং পরিস্থিতি বিবেচনায় বিএনপির উচিত ছিল দেশে একটি কার্যকর নেতৃত্ব তৈরি করা। লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমানকে বিএনপির সক্রিয় কর্মীরা মাথায় তুলে রাখলেও সাধারণ মানুষের সমর্থন তিনি সেভাবে পাচ্ছেন না। যার ফলে বিএনপির আন্দোলনে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্তা নেই।

দলীয় সূত্রমতে, নির্বাচন হয়েই যাবে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ পোষণ করছেন না বিএনপি নেতারা। শুরুর দিকে নির্বাচন করতে দেব না, নির্বাচন প্রতিহত করা হবে মর্মে বক্তব্য দিলেও এখন তারা বলছেন, নির্বাচন হয়ে গেলেও সরকার টিকবে না।

কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ সৃষ্টির পর আন্দোলনের মাধ্যমে কেবল মাত্র হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সরকারের পতন হয়েছে। কিন্তু, গণতান্ত্রিক ধারায় নির্বাচিত সরকারকে কেউ আজ পর্যন্ত উৎখাত করতে পারেনি। ১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন যে সরকার পদত্যাগ করেছিল, তারাও নির্বাচন করে এসে বিরোধীদের দাবি মেনে নিয়ে পদত্যাগ করে নির্বাচন দিয়েছিল। সেটাকে সরকার পতন বলা যাবে না।

অন্যদিকে বিরোধীদের বর্জনের মধ্যে আন্দোলনের মুখে বাংলাদেশের ইতিহাসে কেবল একটি নির্বাচনই বানচাল হয়েছে। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নবম সংসদ নির্বাচনের ঘোষিত ভোট হয়নি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোটের তীব্র আন্দোলনের মুখে দেশে যখন রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়, সে সময় ১১ জানুয়ারি হস্তক্ষেপ করে সেনাবাহিনী। রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ ছেড়ে জারি করেন জরুরি অবস্থা। শপথ নেন ফখরুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তিন মাসের জায়গায় প্রায় দুই বছর ক্ষমতায় থাকে তারা। তার পর থেকেই ক্ষমতার বাইরে বিএনপি।

ক্ষমতা পুনরুদ্ধারে ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে অনির্দিষ্টকালের অবরোধ এবং দফায় দফায় হরতাল কর্মসূচি পালন করে বিএনপি-জামায়াত জোট। শুরু হয় সহিংসতা, পেট্রোল বোমা হামলা। গাড়িতে আগুন, প্রাণহানী, চালক ও যাত্রীদের ঝলসে যাওয়া ছিল এক নিত্য দিনের ঘটনা। বস্তুত, সে সময় থেকেই মূল ধারার রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়ে বিএনপি— এমনটিই মনে করেন রাজনীতি বিশ্লেকরা।

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান বলেন, ‘একটা মূলধারার গণতান্ত্রিক রাজনেতিক দল হিসেবে যেভাবে রাজনীতি করা উচিত, আমরা সেভাবেই করছি। সন্ত্রাস করে ফেলে দেওয়ার নীতি বা কৌশল আমরা অবলম্বন করি না। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করব— এটাই আমাদের লক্ষ্য।’

‘যারা গণতন্ত্রের বিশ্বাসী, সুশাসনের বিশ্বাসী তারা এই বিষয়টা উপলব্ধি করবেন। যারা ভাবছেন জ্বালাও-পোড়াও, মারপিট, গান পাউডার দিয়ে যাত্রীবাহী বাসে আগুন জ্বালানো বিএনপির রাজনীতি, তারা ভুল করছেন। আমরা এ ধরনের কর্মকাণ্ডে বিশ্বাস করি না’— বলেন ড. মঈন খান।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button